
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চান্ন বছরে জাতি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর নানা সরকার ও শাসনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে দেশ। কিন্তু ২০২৫ সালের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যা ঘটেছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ও বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন বহু মানুষ আশা করেছিলেন মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেই আশা তীব্র হতাশায় রূপ নেয়। তাঁর প্রশাসনের অধীনে দেশে ভয়াবহ অস্থিরতা, দমন-পীড়ন ও সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আচরণ নিয়ে। যাঁরা এই দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন, সেই বীর সন্তানদের অবমূল্যায়ন ও অসম্মান জাতির আত্মাকে আহত করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন অবহেলা ও উপহাস বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জঙ্গিবাদ, মব-সন্ত্রাস, বিচারহীনতা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি যেন প্রতিষ্ঠিত আদর্শ হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও ক্ষমতাসীনদের দলীয় দমননীতির কারণে সাধারণ মানুষ অসহায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে পুরো জাতি।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই সময়কাল ভয়াবহ। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা দিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হওয়া ড. ইউনুসের শাসনকালেই বাংলাদেশে কর্মহীনতার এক ভয়াবহ সুনামি বয়ে গেছে। তরুণদের মাঝে হতাশা বাড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে, বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি নতুন রূপে বিস্তার লাভ করেছে।
২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেশে ঘটে গেছে ২৪৪২টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ৩১টি স্থানীয় ও জাতীয় আন্দোলন। ধর্মীয় সম্প্রীতি ভেঙে পড়ে, জাতিগত বিভাজন তৈরি হয়। হিন্দু, বৌদ্ধসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে বর্বর হামলা, লুটপাট ও লাঞ্ছনার ঘটনা।
মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেমন: AP News, Reuters, Al Jazeera, Human Rights Watch, Wikipedia, The Daily Star, BHBCUC তাঁদের প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রিপোর্টগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কথা উঠে এসেছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হত্যা, গ্রেফতারের পরিসংখ্যান অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে।
নারী ও শিশুদের ওপর বর্বরতা এই সময় নতুন মাত্রা পেয়েছে। ধর্ষণ, খুন, লাশ দাহ, ধর্মীয় পরিচয়ে হয়রানি, এসব ঘটনায় জনমনে চরম ভীতি তৈরি হয়েছে। কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা, মন্দির-গীর্জা ভাঙচুর, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল এসব যেন এখন সাধারণ সংবাদ হয়ে গেছে।
এই সময়কালে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো রাষ্ট্রের নীরবতা। যেসব অপরাধ জাতিকে কাঁদিয়েছে, সেসবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবস্থান ছিল একেবারেই দুর্বল বা অনুপস্থিত। নৈতিকতা, মানবিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ যেন চোখের সামনে ভেঙে পড়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার যে অভিজ্ঞতা জাতিকে দিয়েছে, তা একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি প্রমাণ করেছে নোবেল বা খ্যাতি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। জনগণের আস্থা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধই একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি।