
ছবিঃ সংগৃহীত
“সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা।" একটা সময় ছিল, যখন সিনেমা মানেই ছিল অনুভূতির ঝরনাধারা। যেখানে প্রেম ছিল পবিত্র, সম্পর্ক ছিল গভীর, আর কাহিনি ছুঁয়ে যেত মানুষের মনের ভেতরকার সত্যিকে। সেই সময়েই জন্ম নেয় এক কালজয়ী সৃষ্টি ‘সুজন সখী’।
১৯৭৫ সালের আজকের দিনেই মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ জীবনের সরলতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা আর মানবিকতার গল্পে গড়া এই সিনেমা আজ পূর্ণ করলো ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী!
গল্পটা চেনা হলেও অনুভূতিটা ছিল একেবারেই নতুন। দুই ভাইয়ের পারিবারিক দ্বন্দ্বের মাঝখানে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, আর সেই বিচ্ছেদের মধ্যেই জন্ম নেয়া সুজন সখীর এক নিষ্পাপ প্রেম। যে প্রেম জানত না নিজের রক্তের সম্পর্ক, জানত শুধু হৃদয়ের ডাক।
সিনেমাটির সংগীতেও ছিল এক অনন্য জাদু। গেয়েছিলেন আবদুল আলীম ও সাবিনা ইয়াসমীন, যাঁরা পরেই পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চিত্রনাট্য, সঙ্গীত, পরিচালনা—সব দিকেই ছিলেন এক এবং অভিন্ন নাম, খান আতাউর রহমান।
তবে চমক এখানেই। সিনেমাটি মুক্তির সময় পরিচালকের নাম “খান আতার বদলে দেওয়া ছিল “প্রমোদকার”! কারন হিসেবে, ছেলে আগুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বাবা মূলত আর্টফিল্ম করতেন। কিন্তু ‘সুজন সখী’ ছিল বাণিজ্যিক ছবি। তাই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন, যেন কেউ বুঝতে না পারে।” কিন্তু দর্শকের ভালোবাসাই যেন বদলে দিল সব। ছবিটি হয়ে উঠলো সুপারহিট, আর “সুজন সখী” হয়ে গেল এক সাংস্কৃতিক ঘটনা।
এই সিনেমাই বদলে দিয়েছিল বাংলা সিনেমার নায়ক ধারণা। ‘লাঠিয়াল’ আর ‘সুজন সখী’—এই দুই সিনেমার পর ফারুক হয়ে ওঠেন ‘গণমানুষের নায়ক’। গ্রামের তরুণদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে “আমরা সুজনের মতো হতে চাই!”
আর কবরী? তার কোমল হাসি, বিনয়ী সংলাপ, আর সেই চিরচেনা চোখের ভাষা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি দর্শকের ‘সখী’।
আজ বেঁচে নেই কেউই। না খান আতাউর রহমান, না ফারুক, কিংবা কবরী, কি রওশন জামিল...
সবাই ইতিহাস হয়ে আছেন আমাদের স্মৃতির পর্দায়। কিন্তু ‘সুজন সখী’ আজও বেঁচে আছে গান, সংলাপ আর দর্শকের হৃদয়ে।
দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল এই সিনেমার প্রিন্ট, কিন্তু ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উদ্যোগে পুনরায় খুঁজে পাওয়া যায় একটিমাত্র কপি এ যেন হারানো অতীত ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
সিনেমাটির জনপ্রিয়তা এতটাই যে, ১৯৯৪ সালে সালমান শাহ–শাবনূর জুটিতে নির্মিত হয় এর রিমেক, আর কলকাতাতেও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও অভিষেক চ্যাটার্জির অভিনয়ে হয় পুনর্নির্মাণ ।
কিন্তু পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজও দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছে সেই ফারুক–কবরীর মূল ‘সুজন সখী’।
‘সুজন সখী’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসের একটি আবেগ, একটি ঐতিহ্য, একটি অমর প্রেমগাঁথা।