
রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সাড়া বর্তমানে অপর্যাপ্ত বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ফেরত পাঠানোও নিরাপদ নয় বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গারা।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তর (OHCHR) সম্প্রতি প্রকাশ করেছে “Rohingya Perspectives on Pathways to a Safe, Dignified and Peaceful Future” শীর্ষক প্রতিবেদন। এতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত ১২৫ জন রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা জাতিসংঘ, আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (OIC) সক্রিয় নেতৃত্ব কামনা করছেন। শুধু মানবিক সহায়তা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ। প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের আইনি কাঠামো ও চুক্তি অপরিহার্য।
রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে দাবি করেছেন, পূর্ণ নাগরিকত্ব ও রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি, সমান অধিকার, শিক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, জীবিকা ও অবাধ চলাচলের নিশ্চয়তা। রাখাইনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অঞ্চল বা নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠা, ভূমি ফেরত, ক্ষতিপূরণ এবং দায়ীদের দোষ স্বীকার করানো । তাঁরা আরও বলেছেন, প্রত্যাবাসন–পরিকল্পনায় শিক্ষিত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
আরাকান আর্মির ভূমিকা, সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ৭০% এর বেশি মনে করেন, আরাকান আর্মি (AA) তাঁদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। রোহিঙ্গারা আশঙ্কা করছেন, আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে তাঁদের মিয়ানমারে ফেরানো হলে তাঁরা জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত হওয়া, ধর্মীয় নিপীড়ন বা নির্দিষ্ট আশ্রয়শিবিরের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ জীবনযাপনের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীরা ঝুঁকির মুখে আছেন। ২০% অংশগ্রহণকারীর মতে, আরাকান আর্মির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকায় তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম নয় তারা ।
প্রতিবেদনে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫% বলেছেন, জাতিগত বৈষম্য ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সংকটের মূল কারণ। তাঁরা মনে করেন, মুসলিমভীতি তৈরি করে তাঁদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে প্রায় সবাই রাখাইনের বৌদ্ধদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তারা আরও বলেন, মিয়ানমারে মুসলিমভীতি স্বপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়েছে; যাতে তাঁদের অধিকার ও নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায়। তবে প্রায় সব রোহিঙ্গাই রাখাইনের বৌদ্ধদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চেয়েছেন। বিশেষত, রোহিঙ্গা যুবকেরা বলেছেন, যদি তাঁদের সঙ্গে সম–আচরণ করা হয়, তবে তাঁরা দেশের (মিয়ানমার) উন্নয়নে অবদান রাখতে ইচ্ছুক।
নেতৃত্বের সংকট, প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বের সংকটের কথাও উঠে এসেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ৪৫% জানিয়েছেন, তাদের কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নেই। ৬০% নারী তারা বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। স্থানীয় ‘মাঝি’ ও প্রবাসী নেতাদের ওপর তাদের বড় ধরনের অবিশ্বাস রয়েছে।
ওএইচসিএইচআর প্রতিবেদনে উপসংহারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে, আরাকান আর্মির নির্যাতন পর্যবেক্ষণ করা, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নকে মূলধারায় স্বীকৃতি দেওয়া, রোহিঙ্গা তরুণ ও সুশীল সমাজে বিনিয়োগ করা, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করা, ক্ষতিপূরণ ও জমি ফেরতসহ ন্যায়সংগত প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা